ফেনীতে গণহত্যার মামলা নিয়ে রমরমা বাণিজ্য, বাদি জানেন না আসামিকে!

এম এ আকাশ
দলীয়, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, এলাকাভিত্তিক দ্বন্দ্বের জেরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতের মামলায় জড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। হত্যা মামলা ছাড়াও হত্যার উদ্দেশে হামলার অভিযোগ করা হচ্ছে এজাহারে। মামলায় অভিযোগের অভিন্ন ধরন এবং আসামিদের নামের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে শুরু থেকেই। বিশেষ করে অধিকাংশ মামলার বাদীর কাছে তার করা অভিযোগের আসামিরা অচেনা-অজানা। মামলায় আসামির দীর্ঘ তালিকার অনেকের সর্ম্পকে বাদী নিজেই জানেন না।
যা উঠে এসেছে দৈনিক দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদনে। পত্রিকাটি তাদের প্রতিবেদনে দাবি করে স্থানীয় প্রভাবশালী-রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে নাম সংগ্রহ করে প্রতিহিংসামূলক মামলার তালিকায় নাম জড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মামলা ড্রাফটের কপি এজহারভুক্তির আগেই বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে নাম কাটানোর অভিযোগও রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নিরপরাধ অনেকে হচ্ছেন মামলার আসামি। আবার অজ্ঞাতের নামে জড়ানো হচ্ছে সাধারণ আওয়ামী লীগ সমর্থকদের। অনেক বাদী থানায় গিয়ে পর্যন্ত লিখিতভাবে বিবাদীর ব্যাপারে অনাপত্তি জানিয়েছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে বাদী বলছেন আসামি না ধরতে- এমন ঘটনাও রয়েছে। গায়েবি মামলা এবং গণআসামি করে নিরীহ লোকজন হয়রানির শিকার হওয়ায় পুলিশ সুপার এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। তবুও থামছে না সাজানো মামলায় গণআসামি দেওয়ার প্রবণতা। সংঘবদ্ধ একটি চক্র মামলায় নাম দেওয়া ও বাদ দেওয়া নিয়ে বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে। মূল আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও পালিয়ে বেড়াচ্ছে সাধারণ আসামিরা।
জানা গেছে, ফেনীতে ১৬টি মামলায় শত শত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এখনো মামলা করা হচ্ছে। কোনো কোনো মামলায় আসামি করা হয়েছে রাজনীতিতে যুক্ত না থাকা ব্যবসায়ীদেরও। কোনো কোনো মামলায় আসামি করা হয়েছে বিএনপি দলীয় নেতাকর্মী, চাকরীজীবী কর্মী, সাংবাদিক, আন্দোলনকর্মীসহ নানা পেশার মানুষকে। গত ৪ আগস্ট ঘটনার দিন যারা দেশের বাইরে ও ফেনীতে ছিলেন না, এমন অনেককে বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে।
আসামির তালিকায় থাকা সবাইকে চেনেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বাদী বলেন,আমি চিনব কীভাবে। বিএনপির লোকজন আমাকে কিছু টাকা-পয়সা দিছিল, তারাই তো মামলায় নাম ঢুকাইছে। ভালো-মন্দ সবাই মামলায় ঢুইক্যা গেছে। আর যারা ঘটনা ঘটাইছে তারা পালাইছে। আমি সাক্ষ্য দিয়ে নির্দোষ লোকদের বাঁচাতে চাই। এই ঘটনায় করা মামলায় অন্যদের সঙ্গে আসামি করা হয়েছে শতশত অজ্ঞাত মানুষকে।
ফেনী সদর উপজেলার ফরহাদ নগর ইউনিয়নের সুবিদপুর গ্রামের বেলাল আহমেদ বলেন, আমার সঙ্গে একজনের জমিসংক্রান্ত বিরোধ ছিল। সে আমার এইচএসসি পড়ুয়া ছেলেকে ছাত্রলীগ কর্মী বলে ধরিয়ে দেয়। কোনো মামলার আসামি না হলেও তাকে হত্যা মামলায় জড়ানোর চেষ্টা করে। পরে ওসিকে অনেক বুঝানোর পর তিনি একজনের হামলার মামলায় জড়িয়ে আদালতে চালান দেন।
লেমুয়া ইউনিয়ন ছাত্রদলকর্মী আবদুর রহমান শামীমের বড় ভাই আবদুর রহিম বলেন, ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় হত্যাচেষ্টার দুটি মামলায় আসামি করা হয় শামীমকে। মামলায় শামীমকে ছাত্রলীগ নেতা বলে দাবি করা হয়। পরে তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক জানান, হতাহতের এক মামলায় আমাকে জড়ানো হয়েছিল, পরে আমি জানতে পেরে বিশেষ সুপারিশের মাধ্যমে নাম কাটায়। প্রতিহিংসায় মামলায় জড়ানোর ঘটনায় সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ করেছেন কয়েকজন ভুক্তভোগী।
ফেনী মডেল থানা সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী সরোয়ার জাহান মাসুদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ছাত্রলীগ নেতা আবদুর রহিম হৃদয় দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। আরেকটি হত্যা মামলায় ফেনী সদর উপজেলার শর্শদি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম সম্রাটও দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। শিক্ষার্থী মাহবুবুল হাসান মাসুম হত্যা মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিম‚লক জবানবন্দি দিয়েছেন মুরাদ হাসান বাবু।
ফেনী পৌর বিএনপির সদস্য সচিব ও হত্যা মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন ভূইয়া বলেন, আসামি করার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করা হয়। তারপরও কোনো নিরপরাধ কেউ জড়িয়ে গেলে ফাইনাল রিপোর্টের আগে বাদ দেওয়া হবে। আর কারও কাছে চাঁদা চাইলে তারা যেন আমাদের জানান।
ফেনী জেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা আবদুল হান্নান বলেন, নিরীহ কেউ যেন মামলার মাধ্যমে হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামী সবসময় সোচ্চার রয়েছে। প্রয়োজনে যারা হয়রানির শিকার হয়েছেন তাদের আইনি সহায়তা দেওয়া হবে। আমরা প্রতিহিংসার জেরে মামলায় জড়ানোর ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়।
ফেনী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আলাল উদ্দিন আলাল বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় কিছু বিএনপি ও সাধারণ মানুষকে জড়ানোর কথা শুনেছি। তাদের বাদীর মাধ্যমে এভিডেভিট করে বাদ দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট হাফেজ আহমদ বলেন, বিভিন্ন হামলা মামলায় আওয়ামী লীগের নেতারা জর্জরিত হলেও কেন্দ্রীয় কোনো নির্দেশনা না থাকায় এ মুহুর্তে কিছুই করার নেই। তবে তিনি নিরপরাধ নেতাকর্মীদের মামলায় জড়ানোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
ফেনী মডেল থানার ওসি মর্ম সিংহ ত্রিপুরা বলেন, ফেনীতে আন্দোলনে ছাত্র-জনতা নিহতের ঘটনায় আটটি হত্যা মামলা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে আরও আটটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ১৫২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫ জন দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
ফেনীর পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় মামলায় আসামিদের আটকের পর আমরা তাদের আগের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করি। দলীয় পদ-পদবি আছে কি না তা দেখি। ঘটনার দিন তারা কোথায় ছিলেন তা প্রযুক্তির মাধ্যমে জেনে নিই। কোনো নিরপরাধ যেন হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন
ডা. জাহাঙ্গীর এর ভুল চিকিৎসায় দৃষ্টি হারানোর পথে মাদ্রাসা ছাত্র,আদালতে ম...
এম এ আকাশ
ফেনীতে ডাক্তার জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ ওঠ...

ফেনীতে গণহত্যার মামলা নিয়ে রমরমা বাণিজ্য, বাদি জানেন না আসামিকে!
এম এ আকাশ
দলীয়, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, এলাকাভিত্তিক দ্বন্দ্বের জেরে বৈষম্যবিরোধ...

ফেনীতে ছাত্র আন্দোলনে নিজাম হাজারীসহ আ.লীগ নেতারা মিটিং করে হামলার সিদ্ধ...
ফেনীর তালাশ ডেস্ক:-
ফেনীতে ছাত্র আন্দোলনে হামলার ঘটনায় নিজে অংশ নেওয়ার কথা স্বী...

ফেনীতে অপারেশন ডেভিল হান্টে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৯ নেতাকর্মী গ্রে...
নিজস্ব প্রতিনিধি:-
ফেনীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী ...

ফেনীতে বাবার শরীরে গরম তেল ছুড়ে দগ্ধ করল মেয়ে
নিজস্ব প্রতিনিধি:-
ফেনীর পরশুরামে ফাতেমা আক্তার নিহা (১৩) গরম তেল ছুড়ে তার বাবা...
